টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে অনুমোদনহীন অসংখ্য ভবন নির্মাণে বিপর্যস্তের পথে প্রাণ প্রকৃতি। এ কারনে ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কাও সৃষ্টি হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের (বিসি) কমিটির অকার্যকারিতা এবং পৌর প্রশাসনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার ফলে জণদুর্ভোগ বাড়ছে। সাধারণ মানুষের বৈধভাবে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনে নানাবিধ জটিলতা ও ভোগান্তির ফলে বৈধভাবে নকশা অনুমোদন হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, বিগত প্রায় তিন বছরে বিসি কমিটি নানান জটিলতার কারনে একটি সুউচ্চ ভবনেরও অনুমোদন দেয়নি। পৌর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) নির্মাণ বিধিমালা ১৯৫২, ১৯৯৬, ২০২০ অনুসারে ৭ তলা বা ৭৫ ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট ভবনের নকশা অনুমোদন দিতে পারে না। পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ মোঃ শহিদুল ইসলাম ও একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সুউচ্চ ভবনের প্ল্যান পাস হয়েছে মাত্র ৩০টি। তবে অনুমোদনহীন সহস্রাধিক ভবন নির্মাণ কাজ চলছে বলেও তারা নিশ্চিত করেন। নামে বেনামে নিজস্ব জায়গায় ও সরকারি জায়গা, খাল ও নদী দখল করে নকশা অনুমোদনহীন সহস্রাধিক ভবন নির্মাণের কাজ দৃশ্যমান। যেখানে মানা হচ্ছে না ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এর বিভিন্ন আইন, যেমন: অগ্নি প্রতিরোধ ও নিরাপদ আইন ২০০৩, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, প্রাকৃতিক জলাধার আইন ২০১০, বেসরকারি আবাসিক প্রকল্প ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০২৩, মহাসড়ক আইন ২০২১, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩, ভূমি সংক্রান্ত আইন এবং অন্যান্য প্রচলিত আইন বিধিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে না। সকল ধরনের নকশার ক্ষেত্রে বিএনবিসি ২০২০ মোতাবেক ইলেকট্রিক্যাল ও প্লাম্বিং অনুমোদন নেয়া হচ্ছে না। নিজের ইচ্ছামত বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে, সাইট প্ল্যান, বিল্ডিং প্ল্যান, সার্ভিস প্লান, স্পেসিফিকেশন এবং সেটব্যাগের ধার ধারা হচ্ছে না। যার ফলশ্রুতিতে জেলা শহর দিন দিন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এছাড়াও বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে গড়ে উঠছে ফুডজোন, রেস্তোরাঁ, রেস্টুরেন্ট, বিপনি বিতান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও শোরুম। গতানুগতিক ভবনগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ক্লিনিক ও বডি মেসেজ পার্লার। বহুতল ভবনের রূটটবে বাহারি রকমের জমজমাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। ফলশ্রুতিতে ঘটতে পারে অগ্নিকাণ্ড'সহ যে সহজে কোন ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও, দায়িত্বপ্রাপ্ত দায়িত্বহীন কর্মকর্তাদের কারণে হুমকির মুখে বৃহত্তম জেলা টাঙ্গাইল। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলোকে অবগত করলেও অদৃশ্য কারণে তারা নীরব ভূমিকায় রয়েছে। দেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ফল্ট হচ্ছে টাঙ্গাইলের ‘মধুপুর ফল্ট’। গবেষকদের মতে এটি তরমুজের ফালির মতো অসংখ্য প্লেটে বিভক্ত। এ ফল্ট থেকে যদি ভূমিকম্প হয় তবে সেটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকা'সহ আশপাশের জেলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে টাঙ্গাইলে গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। এতে ঝুঁকি বাড়ছে টাঙ্গাইল জেলার। সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ১২, ১৪ থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত অসংখ্য ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। ইতোমধ্যে অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। এসব বহুতল ভবন একাধিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের যৌথ মালিকানায় গড়ে উঠছে। এসব ভবন নির্মাণে ৫০০০ স্কয়ার ফিট অথবা ৭৫ ফিটের ঊর্ধ্বে ভবনগুলো অনুমোদনের কাজ করে গণপূর্ত বিভাগ। পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন দেয় বিসি কমিটি। ভবনের ভার বহনের ক্ষমতা যাচাই'সহ এর স্থাপত্য, কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক, মেকানিক্যাল, প্লাম্বিং, পরিবেশের ছাড়পত্র ও অগ্নিনিরাপত্তার নকশা অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনের এগুলোর অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ ভবন গা ঘেঁষে নির্মিত হচ্ছে। গণপূর্ত বিভাগ টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী শম্ভুরাম পাল বলেন, ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর এর পর থেকে বিসি কমিটি এ পর্যন্ত জেলায় কোন বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয়নি। তবে অসংখ্য অনুমোদনহীন বিল্ডিং নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। অনেক আবেদনও জমা পড়েছে। যারা বিধি মোতাবেক করছেন না তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পৌরসভার একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভবনের প্ল্যান পাস হয়েছে মাত্র ৩০টি। আবেদন জমা পড়েছে ৫৫০টি। তবে অসংখ্য ভবন নির্মাণ কাজ চলছে বলেও তারা জানান। টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বলেন, ‘শহরের বেশির ভাগ বহুতল ভবন যথাযথভাবে নির্মাণ করা হয়নি। আমাদের অবগত ছাড়াই অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেফটি প্ল্যানও ঠিক মত করা হয়নি। ইতোমধ্যে যেগুলো করা হয়েছে প্ল্যানের মধ্যে দুটি সিঁড়ি উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে অনেক ভবন একটি সিঁড়ি দিয়ে নির্মাণ কাজ করেছে।
যে সব অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ হচ্ছে তাদের কাজ বন্ধ রাখার জন্য একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কাজ বন্ধ না রাখলে সেগুলো ভাঙার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর হচ্ছে না। টাঙ্গাইল পৌরসভার প্রশাসক শিহাব রায়হান বলেন, ‘যে সব অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ হচ্ছে তাদের কাজ বন্ধ রাখার জন্য একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কাজ বন্ধ না রাখলে সেগুলো ভাঙার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইল জেলা নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক মোহন বলেন, সড়ক মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে কিছু বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। কোন কোন বিল্ডিং সরকারি জায়গা দখল করে রাস্তাতেও উঠে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের লোক দেখানো দায়সারা নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ব্যাপারে নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুর মোহাম্মদ রাজ্য বলেন, প্লান পাশের জন্য অন্যান্য জেলার চেয়ে টাঙ্গাইলে পৌরসভার ফি বেশি থাকায় এবং মিষ্টির খরচ যোগ হওয়ায়, বৈধভাবে কাগজপত্র পেতে হিমশিম খাচ্ছে জনগণ। এ কারণেই নিরুপায় হয়ে, অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজসে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের সচেতন মানুষজন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেন।